রবিবার ৫ই মে, ২০২৪ ইং ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা (পর্ব-১)

…….নুরুল ইসলাম বাবুল

মাসটা সম্ভত ইংরেজী এপ্রিল এবং বাংলা চৈত্র মাস হবে। আমার বয়স ৬/৭ বছর। রাতের অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূর্ব দিগন্তে উকি দিচ্ছে সূর্য্য। সকাল ৭টা কিংবা ৮টা হবে। মাঠে তখনো পুরাপুরি ধান, পাট বুনন হয়নি। যেদিকে তাকাই ধুধু মাঠ আর মাঠ। কৃষকরা ফসল বোনার জন্য জমি চাষ দিয়ে চৌচির করে রেখেছেন। দিনে প্রচন্ড গরম ভোরে কিছুটা শীত অনুভব হচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার কুয়াশার চাদরে ডাকা পড়ে যায়। আম্র গাছে মুকুল ফুটেছে ডালে ডালে।

ভোরের আলো ফুটতেই আমি আমার সমবয়সী দুই চাচতো ভাই রাস্তায় বের হলাম। রাস্তায় আমাদের সমবয়সী, বয়সী অনেকেই রোজকার মতো এসেছেন। দক্ষিণ দিক থেকে মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। বলে রাখা ভালো তখনও কফিল উদ্দিন কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়নি। আমার বাড়িটা কলেজের বিপরীত দিকে রাস্তার উত্তর পাশে।

আমরা সমবয়সীরা খালি গায়ে হাটছি, হঠাৎ কি এক অজানা শব্দ, ঠুস ঠুস ঠুস, ঠাস ঠাস ঠাস, গ্রের——– গ্রের——– গ্রের—–শব্দ। আমরা সমবয়সীরা আনন্দে আত্মহারা। এমন মজার শব্দ আর কখনো শুনিনি। সময় যতই বাড়ছে, শব্দ ততই বিকট হচ্ছে। আমরা ক’জন সামনে পূর্বে এগুতেই দেখি মানুষজন উত্তর দিকে গ্রামে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে। আমার বড় ভাই মরহুম দ্বীন ইসলাম পাটোয়ারী হাল নিয়ে জমি চাষ করতে গেলেন, (বর্তমানে কফিল উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ সাহেবের বাসার সংলগ্ন)। বিকট শব্দ শুনে গরু এদিক ওদিক চোটাছুটি করছে। ভাই চেষ্টা করছেন গরু নিয়ে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার জন্য। ভয় ছিল রাস্তা পার হতে গিয়ে যদি হানাদারদের গুলির মুখে পড়ে যান। বাড়িতে গরু রেখে ভাই, আরো একজন যেন চিকন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পিটুনির ভয় দেখাচ্ছেন, আর বাড়ির যাওয়ার জন্য ডাকছেন।

বাড়িতে এসে দেখি মা, বাবা, ভাই বোন সকলেই কী যেন এক অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। ঘরের নারিকেল, সুপারি, মরিচ, কিছু চাল, ডাল, হাড়ি, পাতিল, জামা-কাপড় সব বের করে নিয়ে উত্তর দিকে চুটছেন। আমার হাতে ৮/৯টা ছাগলের রশি দিয়ে হাঁটতে বললেন, কিন্তু ছাগল তো হাটছেনা। অন্যেরা ছাগলকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পেটাচ্ছেন। অনেক কষ্টে ছাগল, ৬টা গরু নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে আমাদের লক্ষী ভূঞা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। সেখানে গরু, ছাগল প্রয়োজনী জিনিসপত্র রেখে আমরা উত্তর দিকে ছুটছি।

হাজার হাজার নর, নারী, শিশু, যুবক, আবাল, বৃদ্ধা, প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছেন। অজানা শব্দ গুলি বিকট থেকে বিকটতর হতে লাগলো। শুধু মানুষ কেন? কুকুর, হাজার হাজার কলা বাদুর তারাও ঝাঁকেঝাঁকে চুটছে অজানার উদ্দেশ্যে। অনেক কষ্টে দৌড়াতে দৌড়াতে মা, বাবাসহ অন্যরা আশ্রয় নিলেন পাঁচপাড়া আমার ফুফুর বাড়ি (ধন গাজী পাটোয়ারী বাড়িতে)। আমরা হাড়িরহ্রদ (খালেদগঞ্জ বাজার) যাওয়ার পর দেখতে পাই দক্ষিণ পূর্বদিকে আগুনের কুন্ডুলি, কালো ধোয়া, আর মাথার উপর দিয়ে কী যেন যাচ্ছে শোঁ শোঁ শব্দ করে।

আমরা তো মনে করেছি, আমাদের বাড়িতে আগুন লাগছে। পরে জানতে পারলাম আমাদের পার্শ্বের বাড়ি কালামিয়া ব্যাপারী বাড়ি, চন্দ্রগঞ্জ বাজারে দোকানপাটে আগুন দেওয়া হয়েছে। মা, বাবাসহ অন্যরা থেকে গেলেন ফুফুর বাড়িতে। আমি দলছুট হয়ে মানুষের স্রোতের সাথে পালপাড়া, বিনোদপুর হয়ে এক বাড়িতে মানুষের সাথে আশ্রয় নিলাম। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মা, বাবাকে না পেয়ে কান্না শুরু করলাম। কান্না দেখে কোন একজন নাম, মা, বাবা, বাড়ি জানতে চাইলেন। কান্নাকাটির ফাঁকে নাম ঠিকানা বলার পর পার্শ্বে এক বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সম্ভত দেলিয়াই বাজারে পশ্চিম পার্শ্বে দীঘির পাড়ের বাড়ি। সেখানে চাচাতো ভাইয়ের বউ আমাকে দেখে চিনলেন। পরে আমাকে কিছু খাইয়ে বিকেলে মা, বাবার নিকট পৌঁছাই দিলেন।

এ দিকে আমাকে খোঁজাখুঁজি করে মা, বাবা, ভাই বোন সবাই ক্লান্ত, নির্বাক। পরিবারের সব চেয়ে চোট্টতো তাই আমাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ ফেলেন। অশ্রুসজল হৃদয়ে সকলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।

আসলে ওইদিন পাক হানাদাররা লক্ষ্মীপুর প্রথম প্রবেশ করে। রাস্তার দু’পাশের শত শত বাড়ি, ঘর, হাট, বাজার জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু নর, নারী ও শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে এক জীবন্ত গল্প, জীবনের গল্প, তা কী কখনো ভোলা যায়? সে তো আমার মুক্তিযুদ্ধের গল্প। (চলবে)

লেখক : নুরুল ইসলাম বাবুল, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, জেলা আওয়ামীলীগ-লক্ষ্মীপুর, ইউপি চেয়ারম্যান, ১০নং চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন, সদর-লক্ষ্মীপুর।

     এই বিভাগের আরও সংবাদ

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১